বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ! দিন দিন বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা

বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জাহিদুর রহমান। সকালে অফিসে চলে যান, ফেরেন সন্ধ্যায়। দীর্র্ঘদিন পরিচর্যা করতে না পেরে তাঁর প্রিয় ল্যাপটপটি ধুলোবালি পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। কেনা প্রয়োজন ল্যাপটপ ক্লিনিং কিটস্। কাজের চাপে মার্কেটে যেতে সময় পান না তিনি। একদিন অফিসে বসে ফেসবুক ঘাঁটছিলেন জাহিদ। ফেসবুকে দেখতে পেলেন ল্যাপটপ ক্লিনিং কিটস্রে একটি বিজ্ঞাপন। তিনি সেখানে ক্লিক করতেই চলে গেলেন একটি অনলাইন শপে। সেখানে গিয়ে অর্ডার করলেন ওই ল্যাপটপ ক্লিনিং কিটস্। প্রথমে বুঝতে পারেননি, আসলেই তাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে তাঁর প্রয়োজনীয় পণ্যটি। অর্ডার চূড়ান্ত করতে ৩০ মিনিটের মধ্যে তাঁর মোবাইলে ফোন এলো অনলাইন শপ থেকে। তিনি তাঁর অর্ডারটি চূড়ান্তও করে দিলেন। পরদিনই তাঁর ঠিকানায় পৌঁছে গেল ওই পণ্যটি। পণ্যের দামও তিনি দিয়েছিলেন পণ্য বুঝে পাওয়ার পরই। এর পর থেকে তিনি কোন কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন হলেই আগে খোঁজ করেন অনলাইন শপগুলোতে। প্রয়োজনীয় পণ্য অনলাইন শপে পাওয়া গেলে অর্ডার দেন সঙ্গে সঙ্গে। এমনি করেই বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনধারা।

বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটা


উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এভাবেই বাংলাদেশে ক্রমশ প্রসার ঘটছে অনলাইন কেনাকাটার। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে নিজের অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারি পেয়ে ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনলাইন কেনাকাটায়। পণ্য বুঝে পেয়ে মূল্য (ক্যাশ অন ডেলিভারি) পরিশোধের সুযোগে অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ আরও বেশি। নগরজীবনের ব্যস্ততায় একটু স্বস্তি দিয়েছে এই অনলাইন শপগুলো। ইন্টারনেট সহজ করে দিচ্ছে ক্রেতার জীবনাচরণ। অনলাইন শপগুলোর বিক্রেতারা বলছেন ক্রেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা। জাহিদুর রহমান বলেন, অনলাইন কেনাকাটা আমার জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। একটি জিনিস কিনতে আগে পুরো বিপণিবিতান ঘুরতে হতো। এতে অনেক সময় নষ্ট হতো। এখন খুব সহজেই আমার প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে পারছি অনলাইনে।


অভিজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে অর্ডার করলে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার দোরগোড়ায়। অর্থ পরিশোধে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংক সহায়তাও। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিশোধ করে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় অর্থ। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন। এ কারণে অনলাইন বাজারে কেনাকাটা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন ক্রেতারা। জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, কম্পিউটার, মোবাইল থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, জুয়েলারি, শাড়ি, ঘর গোছানোর সামগ্রী সবই কিনতে পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। এমনকি মাছ, মাংস, কাঁচাবাজারও মিলবে অনলাইন অর্ডারে। দোকান বা শপিংমলে গিয়ে যেভাবে পরখ করে পছন্দের পণ্যটি কেনা হয় ঠিক সেভাবে অনলাইন শপে ঢুকে ছবি এবং দাম দেখে অনলাইনেই কেনার অর্ডার দেয়া যায়। ডেলিভারির সময় হাতে অর্ডার দেয়া জিনিস পেয়ে যাচাই করে নেয়ারও সুযোগ রয়েছে। পছন্দসই জিনিস না পেলে অর্ডার বাতিলও করা যায়। অবশ্য তা শুধু ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।


অন্যদিকে, ক্রেতা-বিক্রেতার এই চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অনলাইনে বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমেও চলছে বেচাকেনা চলে। জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল, মাছ-মাংস পর্যন্ত বিক্রি বেচা-কেনা হচ্ছে এসব ওয়েবপোর্টালে। প্রবাসী ক্রেতাদের জন্যও রয়েছে অনলাইনে পণ্য কেনার ব্যবস্থা। এ ছাড়া রেলওয়ে টিকেট, হোটেল বুকিং এবং অভ্যন্তরীণ বিমানের টিকেট কেনার সুবিধাও দিচ্ছে বেশ কয়েকটি সাইট। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যার মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ বা দুই লাখ গ্রাহক নিয়মিত অনলাইনে কেনাবেচা করেন। অনলাইন বাজারে যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়, তেমনি বিভিন্ন উৎসবের পণ্যসম্ভারে সেজেছে আমারদেশ ই-শপ (www.amardesheshop.com)ঈদ উপলক্ষে একেবারে নতুন করে সাজানো হয়েছে সাইটটি। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পণ্য। এখনই ডটকমে (www.akhoni.com) ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যাচ্ছে আগের মূল্যের চেয়ে ২০ শতাংশ কম দামে। অনলাইনে বেচাকেনার এই সাইটটির মাধ্যমে ছবি দেখে অর্ডার দিলে একদিনেই বাসায় পৌঁছে যাবে পণ্য। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবিসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা করার সুযোগ আছে। এখনই ডটকমের প্রধান নির্বাহী শামীম আহসান বলেন, গ্রাহকদের আরও বেশি পণ্য সুবিধা দিতে এখনই ডটকম ই-শপ চালু করেছে। এতে যে কেউ অনলাইনে দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের ব্যবসার প্রসার করতে পারবেন।

কারিগর ডটকমে (www.karigor.com) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-সোনাদিয়ার বিখ্যাত শুঁটকি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য, টি-শার্ট, নকশিকাঁথা, সৃজনী, হাতের কাজ করা বিছানার চাদর, উপহার সামগ্রী ছাড়াও ২৪ ঘণ্টাব্যাপী মোবাইলে ব্যালান্স রিচার্জের ব্যবস্থা রয়েছে। কারিগর ডটকমের নির্বাহী পরিচালক নূর নবী দুলাল বলেন, বিলাসবহুল কোন শপিংমল কিংবা দামি কোন ব্র্যান্ডের পণ্যটি খুব সহজেই কিনতে পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান ই-শপিং সুবিধা দিচ্ছে, তাদের মধ্যে একমাত্র কারিগর ডটকমই ২৪ ঘণ্টা সর্বক্ষণিক কাস্টমার সার্ভিস সুবিধা দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্র্যান্ডস ডটকম (www.bangladeshbrands.com) সাইটটিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় সব ব্র্যান্ডের পোশাক পাওয়া যায়। ঈদ উপলক্ষে একেবারে নতুন করে সাজানো হয়েছে সাইটটির হোমপেজ। আপলোড করা হয়েছে নতুন নতুন পণ্যের ছবি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদেকা হাসান বলেন, সাইটটিতে অহং, এক্সট্যাসি, লেভেন্ডার, বিবিয়ানা, স্মার্টেক্স, রঙ, প্রবর্তনা, মেনজ ক্লাবসহ প্রায় ৫৪টি ব্র্যান্ডের পোশাক কেনা যাবে। এ সাইটে রয়েছে প্রায় ৩১ হাজার পণ্য।

আজকেরডিল ডটকমের (www.ajkerdeal.com) মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে ক্রেতাদের সরবরাহ করা হয়। নারীদের জন্য শুধু বাহারি সব জামদানি শাড়ির সমাহার নিয়ে রয়েছে রূপকথা জামদানি ডটকম (www.rupkothajamdani.com)অনলাইন শপটির প্রতিষ্ঠাতা তরুণ উদ্যোক্তা শারমিন রাবেয়া বলেন, ঈদ উপলক্ষে সব ধরনের জামদানিতে থাকছে ছাড়।

ফেসবুকেও বেশ কিছু গ্রুপের মাধ্যমে চলছে জমজমাট বিকিকিনি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্য সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে এখন সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে বড় এ মাধ্যমটি ব্যবহার করছেন। দেশের অনলাইন বেচা-কেনার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম সবচেয়ে বড় সাইট বিক্রয় ডটকম (www.bikroy.com)প্রায় ২০ হাজার ক্রেতা-বিক্রেতা প্রতিদিন এই ওয়েবপোর্টালে প্রবেশ করেন। প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার বিজ্ঞাপন পায় এই ওয়েবপোর্টাল। বিক্রয় ডটকমের বিপণন ব্যবস্থাপক ঈশিতা শারমীন বলেন, অনেক সময় এখানে বিজ্ঞাপন দেয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। অনলাইন বেচা-কোনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অনেকটাই এগিয়ে গেছে ওএলএক্স ও এখনই পটকমও।

টপ অল ব্রান্ড বিদেশ থেকে সরাসরিভাবে আমদানিকৃত পণ্য দিয়ে সাজিয়েছে তাদের সাইট। তারা সব ধরনের অরিজিনাল বিদেশী পণ্য সরবারহ করে থাকে। আপনার চাহিদামত যেকোন বিদেশী পণ্য এদের কাছে অর্ডার দিতে পারবেন।

অনলাইন বেচাকেনা হয় দুইভাবে। বিক্রয়ডটকমের মতো ওয়েবপোর্টালে বিক্রেতা তার পুরনো পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। আগ্রহী ক্রেতা সেই বিজ্ঞাপন দেখে ওই বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে দুজনের আপসের ভিত্তিতে পণ্যটি বেচাকেনা হয়। এ জন্য অবশ্য নগদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব ওয়েবসাইটে এখন নতুন পণ্যের বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেয়া শুরু হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আবার বেশ কিছু ওয়েবপোর্টাল রয়েছে, যারা নিজেরাই পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে। ক্রেতা শুধু পণ্য পছন্দ করে অনলাইনে ক্রেডিট বা ডেভিট কার্ডের মাধ্যমে অথবা ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে বিল পরিশোধ করেন।

আজকের ডিল ডটকম এর হেড অব অপারেশন দেবাশীষ ফণী বলেন, ২০১১ থেকে আজকের ডিল ডটকম যাত্রা শুরু করে। তিনি বলেন, শুরুর দিকে প্রতিদিন একটি পণ্যও আমরা বিক্রি করতে পারতাম না। তবে এখন প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি পণ্য আমরা বিক্রি করতে পারছি। তিনি বলেন, আসলে আমরা যে সময় যাত্রা শুরু করি, তখন আমাদের দেশে ইন্টারনেট সেবাও খুব দুর্বল ছিল। একই সঙ্গে দেশের মানুষ ওই সময় অনলাইন কেনাকাটায় খুব একটা পরিচিতও ছিল না। তিনি আরও বলেন, থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা চালুর পর থেকেই অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। তিনি বলেন, দেশে যে কটি অনলাইন শপ রয়েছে তাদের মধ্যে আমরাই প্রথম বাংলায় ওয়েব পোর্টাল করেছি। দেশের সকল মানুষের দোরগোড়ায় এ সেবা পৌঁছে দিতেই আমাদের এ উদ্যোগ।
দেবাশীষ বলেন, আমাদের ওয়েবসাইটে যাঁরা ভিজিট করেন, তাঁদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্ডার আমরা পাই। বাকিরা অর্ডার করেন না। ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ ভিজিটরের পণ্য না কেনার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এঁদের মধ্যে অনেকের পণ্যটি প্রয়োজন হয় না, আবার অনেকে এখনও অনলাইনে কেনাকাটার সঙ্গে পরিচিত নন। দেশের মানুষ অচিরেই অনলাইনে কেনাকাটা করতে নির্ভরশীল হয়ে উঠবে বলে আশা দেবাশীষের। দেবাশীষ ফণী আরও বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য প্রযুক্তিনির্ভর শপিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানো। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর কেনাকাটায় ক্রেতাদের অভ্যস্ত করে তাদের সময় বাঁচানোও আমাদের অন্যতম লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেন এই আজকের ডিলের এ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, অনলাইনে কেনাকাটা করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আপনি যা কিছুই চান, বাড়িতে বসে তা পেতে পারেন এবং পণ্যমান বিষয়ে ছাড় না দিয়েই। অনলাইনে কেনাকাটা করার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি আগামী বছরগুলোতে এর ব্যাপক সম্ভাবনাকে জোরালোভাবে ফুটিয়ে তুলছে।

1 টি মন্তব্য:

  1. উন্নত দেশগুলোতে ই-কমার্স বিজনিস অনেক জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের ই-কমার্স সাইট তেমন একটা জনপ্রিয় নয় । এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারন লক্ষ্য করা যায় । জানুন বিস্তারিত

    উত্তরমুছুন